র‌্যাপ গানকে প্রতিবাদের অস্ত্র বানিয়েছেন এ বি এম নোমান আজাদ


বাগেরহাট নিউজ ২৪ ডেস্ক প্রকাশের সময় : মে ২০, ২০২৫, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন /
র‌্যাপ গানকে প্রতিবাদের অস্ত্র বানিয়েছেন এ বি এম নোমান আজাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্যরকম প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে র‌্যাপ গানকে বেছে নিয়েছেন এ বি এম নোমান আজাদ, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ধারালো বক্তব্য তুলে ধরছেন সংগীতের মাধ্যমে। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় র‌্যাপারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের গান মুহূর্তেই ছাত্রদের মাঝে উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয়, আন্দোলনের মঞ্চে প্রাণ এনে দেয় এই সংগীতধারা।

অনেক র‌্যাপারকে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠের জন্য জেল খাটতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন ও দমন-পীড়ন। কেউ কেউ আবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য উচ্চারণ করে গেছেন গানের মাধ্যমে। এদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাম এ বি এম নোমান, যিনি একের পর এক প্রতিবাদী র‌্যাপ প্রকাশ করে আন্দোলনের কর্মীদের মাঝে সাহস, শক্তি ও প্রেরণা ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার কণ্ঠে প্রতিবাদ শুধু সুর হয়ে ওঠেনি, তা হয়ে উঠেছে আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।

জুলাই বিপ্লবের সময় অনেক র‌্যাপারই তাদের গানের মাধ্যমে আন্দোলনের জোয়ারে নতুন উদ্দীপনা এনেছিলেন। তবে বেশিরভাগের অংশগ্রহণ ছিল ক্ষণস্থায়ী ও ছন্দহীন। এই জায়গায় ব্যতিক্রম ছিলেন এ বি এম নোমান। তিনি জুলাই ২০২৪ থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পাঁচটি প্রতিবাদী র‌্যাপ প্রকাশ করেন, যা শুধু জনপ্রিয়তাই পায়নি, বরং আন্দোলনের ভাষাকে দিয়েছে আরও ধার, আরও শক্তি। তাঁর গানগুলো হয়ে উঠেছিল রাজপথের স্লোগান, প্রতিবাদের অনুরণন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়, কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে প্রকাশিত হয় একটি জোরালো র‌্যাপ গান—‘কোটা আন্দোলন’। আন্দোলন দমাতে যখন হাসিনা সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে “শিবির” ট্যাগ দিতে শুরু করে, তখন তার জবাবে এ বি এম নোমান মুক্তি দেন আরেকটি র‌্যাপ—‘মেধাবীদের বাংলাদেশ’, যেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন। এরপর ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর প্রকাশিত হয় তীব্র স্যাটায়ার ও উদযাপনমুখী র‌্যাপ ‘শেখ হাসিনা পালাইছে’, যা মুহূর্তেই সাড়া ফেলে দেয়।

নোমানের সাম্প্রতিক র‌্যাপগুলো অনলাইনে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। ‘শত্রু আমগো কেডা?’ গানটির মাধ্যমে তিনি ভারতের পানি আগ্রাসন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। এরপর তার সর্বশেষ রিলিজ ‘সুশীল’ শিরোনামে আরেকটি তথ্যবহুল র‌্যাপ গান। প্রতিটি গানে উঠে এসেছে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যা শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং মিলিয়নেরও বেশি ভিউ অর্জন করেছে ইউটিউবে।

গান নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে নোমান বলেন, “আমি গান করি শুধুই বিনোদনের জন্য না, এগুলো আমার প্রতিবাদের ভাষা। আমি চাই মানুষ যেন আমার গানে নিজের কথা খুঁজে পায়। অন্যায় দেখলেই গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছি, ভবিষ্যতেও করে যাব।”

নোমান গানের সাফল্যের পেছনে যাদের অবদান রয়েছে, তাঁদের স্বীকৃতি দিতেও ভোলেননি। বিশেষভাবে তিনি উল্লেখ করেন তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং গানের গীতিকার ও কবি রাকিবুল এহসান মিনারের কথা। তিনি বলেন, “মিনার আমার খুব কাছের মানুষ। আমরা একে অপরকে ভালোভাবে বুঝি এবং শ্রোতাদের চাহিদাও বোঝার চেষ্টা করি।”

এছাড়াও, তিনি গানগুলোর সফল বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা পরিচালক সাদ আল আমিন, সাউন্ড ডিজাইনার আমির হামজা খান এবং কবি সাইফ আলি খানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। এবং তিনি বলেন যার কথা না বললে নয় , তার গানের পিছনে যিনি মূল কারিগর হিসেবে নিরালশ ভাবে কাজ করেছেন  তাকে সর্বদা উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন ধানশালিক ষ্টুডিওর সিইও শিল্পী দিদারুল ইসলাম। এবং তার স্টুডিওতে তারই প্রযোজনায় প্রথম পাঁচটি র‍্যাপ গান রেকর্ড হয়। এজন্য তিনি শিল্পী দিদারুল ইসলাম প্রতি-ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছে এই প্রতিবাদী সঙ্গীতযাত্রা।

নোমান জানান, ২০২৩ সালের জুলাই মাসের আন্দোলনের সময় তিনি জীবন ঝুঁকি নিয়ে গান তৈরি করেছেন। বিশেষ করে ৪ আগস্টের ঘটনা তার স্মৃতিতে গভীরভাবে মনে গেথে আছে। সেদিন ঢাকার শাহবাগ ও বাংলামোটর এলাকায় উত্তাল পরিস্থিতিতে যখন পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি এবং যুবলীগ–ছাত্রলীগের সমন্বয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গুলিবর্ষণ চলছিল, তখন তিনিও ওই অরাজকতার মধ্যে আটকে পড়েন। গুলির শব্দ আর ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে স্টুডিওতে পৌঁছে গান রেকর্ড করার অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং।

নোমান বলেন, “ওই সময়টায় আমি শুধু শিল্পী ছিলাম না, ছিলাম একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীও। সত্য বলার দায় থেকেই আমি গান করেছিলাম। আর সেই গান রেকর্ড করতে গিয়ে যে ঝুঁকি নিয়েছি, সেটা শুধু একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা থেকেই।”

গান প্রকাশের পর থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে তিনি বিভিন্ন ধরনের হুমকির মুখোমুখি হন। আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা তাকে ফোনে ও সামাজিক মাধ্যমে হত্যার, গুমের হুমকি দেন। এখনও তার ফেসবুক পেজ এবং ব্যক্তিগত ইনবক্সে এসব হুমকির বার্তা ও কমেন্ট দৃশ্যমান। তবে এসব তাকে থামাতে পারেনি। তিনি বলেন, “ভয়ের কাছে মাথা নত করিনি, করবোও না।”

র‌্যাপার নোমান ছোটবেলা থেকেই মেলোডি ঘরানার গান করতেন। ২০২১ সাল থেকে তিনি র‌্যাপ গানে মনোনিবেশ করেন এবং সেই মাধ্যমেই স্বৈরাচারী সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। এর আগে তার গাওয়া ‘সুখ চাই’, ‘বেসামাল’, ‘জং ধরা মনটা’, ‘এভাবে কী বাঁচা যায়’—এই গানগুলোতেও উঠে এসেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা।

নোমান কুমিল্লার মুরাদনগরের হিরাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। র‌্যাপ সংগীতের পাশাপাশি তিনি নাট্যকার ও নির্দেশক হিসেবেও কাজ করছেন, যেখানে তার সৃজনশীলতা ও সমাজ সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়।