নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার দেবীপুর গ্রামের ইকবাল হোসেন যেন প্রমাণ করেছেন, বয়স শুধুই একটি সংখ্যা। ৬০ বছর বয়সেও তার দৌড়ানোর অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য দেশ-বিদেশে এনে দিয়েছে একের পর এক চ্যাম্পিয়নের মুকুট।
ইকবাল হোসেন জীবনের শুরু থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিলেন নিবেদিত। তবে পেশাগত জীবনে তিনি মোংলার বসুন্ধরা মেঘনা সিমেন্ট কারখানায় যুক্ত হন ২০০৩ সালে। শৈশব থেকেই খেলাধুলায় আগ্রহী ইকবাল ২০১৩ সালে, ৩৬ বছর বয়সে, ওয়ার্ল্ড মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্সের বাংলাদেশ কাস্টমস দলের হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যাথলেটিক্সে অংশগ্রহণ শুরু করেন। দীর্ঘ দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটানের আন্তর্জাতিক মঞ্চেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
গত এক দশকে প্রায় ৩০টিরও বেশি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তিনি এবং জয় করেছেন ২৫টিরও বেশি পুরস্কার। তবু আজও সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। নিজের বড় ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী, আর ছোট ছেলে খুলনা সিটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করছেন। এই দুঃসাহসী অ্যাথলেট সরকারের কাছে ছোট ছেলের পড়াশোনার শেষে মেধা বিবেচনা করে একটি চাকরির আবেদন জানিয়েছেন, যাতে জীবনের বাকি সময়টা একটু স্বস্তিতে কাটাতে পারেন।
০৭ মার্চ শুক্রবার ভোরবেলা সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রনজিৎপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে একদম নিঃসঙ্গভাবে দৌড়াচ্ছেন। কুয়াশার তীব্র চাদর ভেদ করে সূর্য ওঠার আগেই, নিজের শৈশবের প্রিয় মাঠে পদচারণা করতে দেখা যায় তাকে। প্রতিদিন সকালে, দেবীপুর থেকে ২ কিলোমিটার কাচা পাকা রাস্তা হেঁটে এসে তিনি এই মাঠে উপস্থিত হন। দুটি ঘন্টা ধরে নিজেকে শারীরিকভাবে সুস্থ ও ফিট রাখতে, সেই ছোটবেলার স্মৃতি মুছে না ফেলেই দৌড়ান তিনি, যেন সময় থেমে আছে, আর প্রতিটি পদক্ষেপ তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করে।
স্থানীয় নারায়ণ পাল বলেন, আমাদের বয়সে আমরা হাঁটতেও কষ্ট পাই, কিন্তু ইকবাল দৌড়ে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করে চলেছেন। তিনি আমাদের গর্ব।
ইকবাল হোসেনের চাচাতো বড় ভাই আপসার হোসেন বলেন, ইকবাল আমার ছোট ভাই। তাকে দেশ-বিদেশে দৌড়াতে দেখে আমাদের খুব আনন্দ হয়। সে আমাদের পরিবারের গর্ব।
ইকবালের বড় ভাইয়ের ছেলে তরিকুল ইসলাম বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখছি ইকবাল কাকা খেলাধুলার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তার কঠোর পরিশ্রম এবং খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসা আমাদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। তার দেশ-বিদেশ থেকে পাওয়া পুরস্কারগুলো দেখে আমাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, তিনি যেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান।
স্থানীয় কিশোর সেলিম হোসেন বলেন, “আমার বয়স ১৬ বছর, তবুও আমি ইকবাল কাকার মতো দৌড়াতে পারি না। তিনি আমাদের বাগেরহাটের গর্ব। তিনি বাংলাদেশর গর্ব
এস. এম. ইকবাল হোসেন বলেন, “ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ। ২০১৩ সালে, যখন আমার বয়স ছিল ৩৬ বছর, তখন আমি বাংলাদেশ কাস্টমসের মাধ্যমে বাংলাদেশ মাস্টার্স গেমসে অংশগ্রহণ করি। এরপর থেকে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের মাধ্যমে খেলাধুলা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। ২০১৩, ২০১৯ এবং ২০২৪ সালে ভারতে, ২০২০ সালে নেপালে এবং ২০২৪ সালে ভুটানে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। এসব প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পেরেছি। বর্তমানে দেশে অনুষ্ঠেয় খেলাগুলোতে অংশগ্রহণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি।
তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত আমি ৬ বার জাতীয় পর্যায়ে এবং ৪ বার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। আমার অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে প্রায় ৩০টির মতো মেডেল ও পুরস্কার। আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা, সরকারের সহযোগিতায় আমার দুই সন্তানের একজন যেন মেধার ভিত্তিতে সরকারি কোনো দপ্তরে কাজের সুযোগ পায়।”
স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিল্লাল শেখ বলেন “ইকবাল হোসেন শুধু আমাদের এলাকার নয়, পুরো দেশের গর্ব। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রম প্রমাণ করে যে, সংকল্প থাকলে বয়স কোনো বাধা নয়। আমরা চাই, সরকার তাকে যথাযথ সম্মাননা ও সহযোগিতা প্রদান করুক, যাতে তিনি আরও ভালোভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। পাশাপাশি, তার সন্তানদের জন্যও যেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ইকবাল শুধু একজন ক্রীড়াবিদ নন, তিনি আমাদের যুবসমাজের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
আপনার মতামত লিখুন :