অদম্য জরিনা: সংগ্রাম থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার এক অনন্য গল্প


বাগেরহাট নিউজ ২৪ ডেস্ক প্রকাশের সময় : মার্চ ৯, ২০২৫, ৯:৫১ পূর্বাহ্ন /
অদম্য জরিনা: সংগ্রাম থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার এক অনন্য গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক :

অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে আসার গল্প শুধু গল্পের বইয়েই সীমাবদ্ধ নয়; বাস্তব জীবনেও কেউ কেউ কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেন।বাগেরহাট সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের রহিমাবাদ গ্রামের জরিনা বেগম(  ৫৭)তেমনই একজন নারী, যিনি চরম দারিদ্র্য, অত্যাচার ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে আজ মাথা উঁচু করে দাওয়াতে শিখছেন তিনি । একসময় যিনি অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতেন, আজ তিনি নিজেই একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু এই সাফল্যের পথ সহজ ছিল না; হৃদয়বিদারক কষ্ট ও সংগ্রামের পরেই এসেছে তার জীবনের এই পরিবর্তন।

জরিনা জন্মগ্রহণ করেন এক অভাবী পরিবারে, যেখানে ১২ ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে ওঠা ছিল কঠিন সংগ্রামের মতো। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চলত না, তাই ছোটবেলা থেকেই তাকে নামতে হয় কঠোর পরিশ্রমের জীবনে। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে যেত, তখন সাত বছর বয়সী জরিনা বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়ে কাজ করত। কখনো ধান কুড়ানো, কখনো নদীতে মাছ ধরা এভাবেই তার শৈশব কেটেছে।

জরিনার সংগ্রামের শুরু এক হতদরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে। ছোটবেলায় যখন অন্যরা স্কুলে যেত, তখন তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন।  ১৯ ৮৫ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে  বছর বয়সে  বিয়ে হলেও, স্বামীর মাদকাসক্তি ও নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তবুও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব সহ্য করেন। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে তিন সন্তানকে নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায় সেখানে গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন সন্তানদের ঘরে রেখে কাজে যেতেন, । বড় মেয়েও একসময় তার সঙ্গে কাজে যোগ দেয়।

কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একটু স্বস্তি পেলেও দুঃখ তার পিছু ছাড়েনি। স্বামী অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসলেও কিছুদিন পরই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে  । তখন  যা সঞ্চয় করেছিলেন, তার সবটুকু স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় হয়। এরপর একেবারে শূন্য হাতে ফেরেন গ্রামে নিজেও আবার দিনমজুরির কাজে নেমে পড়েন—মাটি কাটা, মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করা, যা কিছু পাওয়া যায় তাই করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি, তিনি মারা যান।

স্বামীর মৃত্যুতে দিশেহারা জরিনা তখন ব্র্যাকের ইউপিজি কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ষাঁড় গরু পান। সেখান থেকে তার জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তিনি গরুটিকে যত্ন নিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন। পরে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এ তার ঘর ভেঙে গেলে ব্র্যাক তাৎক্ষণিক সহায়তা দেয়, টিন ও বাঁশের ব্যবস্থা করে দেয়। তিনি নিজেই ঘর মেরামত করেন। পাশাপাশি হাঁস-মুরগির খামার, ছাগল পালন, জৈব সার বিক্রি এবং সবজি চাষ শুরু করেন।

আজ তার গরু , হাঁস-মুরগির খামার থেকে ভালো আয় হচ্ছে, কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করে তিনি লাভবান হচ্ছেন। এখন আর তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় না। তিনি তার মেয়েকে ঢাকায় আর থাকতে দেবেন না, বরং বাড়িতে এনে নিজের গরুর খামার বড় করবেন।

 জরিনা বেগমের প্রতিবাসী  ময়না আক্তার বলেন, “রোজিনা আক্তারের পরিশ্রমের কাছে পুরুষের  পরিশ্রমও হার মানবে। গাছে ওঠা থেকে শুরু করে ধান রোয়া পর্যন্ত সবই পারেন তিনি।” তার ইনকাম করে খাওয়ানোর মতন এখন কেউ নেই। সরকার যদি তার একটু সহযোগিতা করতো তাহলে বাকি জীবনটা সে ভালোভাবে কাটাতে পারতো। এনজিও থেকে লোন নিয়ে একটা গরু নিয়েছে, এই গরু নিয়ে যাচ্ছে সে এখন।

 জরিনা বেগমের মেয়ে সুলতানা আক্তার বলেন, “ছোটবেলায় দেখছি  আমার বাবা আমার মাকে অনেক নির্যাতন করেছেন, তারপরও আমার মা আমাদের নিয়ে সংসার করে গেছেন। আমার মা যে পরিশ্রম করেন, আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষও এত পরিশ্রম করবে না।”

জরিনা বেগম বলেন, “সংসারের অভাবের তাড়নায়, নির্যাতনের কষ্টে কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে দেব, কিন্তু আমার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হাল ছাড়িনি। আজ আমি কারও সাহায্যের মুখাপেক্ষী নই। আমার একটাই চাওয়া, আমার সন্তানরা যেন আর কষ্ট না করে, সুখে থাকে।

জরিনা বেগম আরো  বলেন, “৪০ বছর আগে জোর করে মোঃ ছোটন আমাকে বিবাহ করেন। দুই এক বছর সংসার ভালোই কেটেছিল, তারপর মারধর শুরু হয়। তিন ছেলেমেয়ে হলেও নির্যাতন কমেনি আমার উপর থেকে। নির্যাতন সইতে না পেরে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে চাকরিও করেছি, ফুটপাতে মাছ, ডিমসহ কাঁচা সবজি বিক্রি করেছি। দুই বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হলে বাড়িতে আসি। বাড়িতে আসার পর মাথা গুজার ঠাঁই ছিল না; কোনভাবে ঠাঁই হলো ছোট্ট একটি ঘরে ।  দুই মেয়েও এক ছেলে ছেলে বিয়ে করে সংসার নিয়ে থাকে আমার খোঁজ নেয় না এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আর এক মেয়েকে   দেখতে হয় আমার।

জরিনা বেগমের জীবনসংগ্রাম প্রমাণ করে, যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, তাহলে দারিদ্র্য, নির্যাতন বা কোনো বাধাই একজন নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে রাখতে পারে না।

প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের ঘুরে দাঁড়াতে বাগেরহাটে কাজ করছে ইনিশিয়েটিভ ফর রাইট ভিউ, বাঁধন মানব উন্নয়ন সংস্থা, ওয়ার্ল্ড ভিশন, রুপান্তর, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তাদের সহায়তা পেলে আরও অনেক জরিনার জীবন বদলে যেতে পারে।